Saturday, July 15, 2017

মিত্রা ঘোষ চট্টোপাধ্যায়



এডমন্টন
মিত্রা ঘোষ চট্টোপাধ্যায়


টরন্টোর পশ্চিম দিকে, কানাডার আলবার্টা প্রভিন্স-এর মধ্যে উন্নত শহর এডমন্টন আর ইউনিভার্সিটি অব আলবার্টাও একটি প্রখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত  ঝুমরি এখানে ইংরেজি সাহিত্যে গবেষনা আর পড়ানর কাজে, সেই সুবাদেই আমাদের এডমন্টন-কে চেনা; বার বার আসা-যাওয়া। ২০০৪-এ ওদের বিয়ের পর থেকে, মেয়ে জামাই ইউনিভার্সিটির খুব কাছাকাছি এক এপার্মেন্ট-এ এসেছে। ২০০৫-এর আগষ্ট থেকে ঝিলাম এল ওদের কাছে, গ্রেড টুয়েল্‌ভ সমাপ্ত করতে। তার দিদি-র ইচ্ছে, বোনের লেখাপড়া আরো ভাল হোক আর তাদের মা আবার নিজের কর্মজগতে, জিওলজিস্ট-এর জীবিকায় ফিরে যাক।

আমি লিখছি পরবর্তী বছরের, ২০০৬-এর শীতের কথা, কানাডায় ঝিলাম আর আমার একটানা থাকার ইতিহাসের শেষ বছর, শেষ পর্ব, যখন আমিও এডমন্টনে কয়েক মাস ছিলাম। 

২০০৩ এ চাকরী ছেড়ে দিলেও এ-দেশে এনভানমেন্টাল প্রটেকশন টেকনোলজি পড়েছি দু-বছর, ২০০৫-এ ডিগ্রীও পেয়েছি বহু বছর আগে ইউ কে-র থেকেও তিন্ মাসের একটা ডিপ্লোমা হয়েছিল এক-ই বিষয়ে। কলকাতার এক নামী অফিসের পরিবেশ বিভাগে আমার চাকরী প্রায় পাকা, বছর খানেক তাদের সঙ্গে চাকরি করেছি কানাডায় চলে আসার আগে—এমন কি গত বছর বিনা পারিশ্রমিকেও তাদের বড় একটা কাজ করে দিয়েছি, কাজ করব, কত মায়না পাব ঠিক হয়ে গেছে। এমন কি, আমার আবেদ গৃহীত হয়ে নিয়োগত্র-ও চূড়ান্ত হবার পথে। কলকাতায় ফিরেই কাজে যোগ দেব। মেয়েরা অন্য প্রভিন্স-এ, আমি কলকাতায় নতুন চাকরি করব, দিলীপ কানাডার জীবনে, এ-দেশে কাজ করে খুশী-ই, কিন্তু অত বড় একটা টাউন হাউস একা সামলাতে চাইল না। এ ছাড়া আলাদা তিনটি এস্টাব্লিসমেন্ট-এর খরচের কথা আছে। আমরা আমাদের ফার্নিচার, বড় বড় জিনিষপত্র বিক্রি-বিলি বন্টন করে প্রয়োজনীয় জিনিষ নিয়ে মিসিসাগার মল্টনে আমাদের এক পরিচিত পরিবারের টাউন হাউসে তিনতলায় ভাড়া নিলাম। দিলীপ একা থাকবে, পেয়িং গেষ্ট। সব বন্দোবস্ত করে দিয়ে আমি কলকাতায় চাকরি করতে ফিরব। 

ফেরার টিকিট কাটা, স্যুটকেশ গোছানো। দিলীপ ছুটি নিয়েছে বিকেলে আমাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবে বলে। দুপুরে বড় মেয়ের ফোন এলো-- আমি টিকিট ক্যানসেল করে দিয়ে ঝিলামের কোর্স শেষ হওয়া পর্যন্ত এডমান্টনে গিয়ে থাকতে পারবো কিনা। ছোট বোন ঠিকমতো স্কুলে যাচ্ছে না, স্কুলে গেলেও, যে ক্লাস পছন্দ নয়, সে-সব ক্লাস ও করছে না। এমন কি, ক্লাসের প্রজেক্ট জমা দেওয়া, পরীক্ষা দেওয়া- এগুলো একেবারেই অনিয়মিত জানার পর থেকে ঝুমরি খুব চিন্তিত-বোনকে ভালো ভাবে বোঝান অথবা বকাবকি কোনটাতেই কাজ হচ্ছে নাসে মুখ ফুঁটে কোন প্রতিবাদ না করলেও, তার যেমন ইচ্ছে তেমনই চলছে। দিদি চিন্তিত
       
সুতরাং, সকালেই বৃটিশ এয়ারওয়েস অফিসে ফোন করে জানতে পারলাম যে যেহেতু আমার এই টিকিটটা রিটার্ন জার্নির, একবার পেছন যাবে এবং আরো একবার তারিখ পাল্টাতে হলে পঞ্চাশ ডলার লাগবে। মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে, জুন মাসের শেষে ঝিলামের পরীক্ষা হয়ে যাবে বলে জুলাই-এর প্রথম দিকে আমার রিসার্ভেশন পিছিয়ে দিলামপরের দিনের এডমান্টনে যাওয়া আর টরোন্টোয় ফেরত আসার টিকিট কাটা হল চার ঘণ্টার প্লেনে এডমান্টনে হাজির হয়ে গেলাম যথাসময়ে। মিশার এক বন্ধুর থেকে একটা পুরনো গাড়ি প্রাপ্তি হয়েছিল ওদের। সেই গাড়ি চালাচ্ছিল মিশা আর সেই ঝরঝরে গাড়িতে চড়ে কিছুদূর পরপর থামতে থামতে প্রবল হাসি-কৌতুকের মধ্যে এডমান্টনের বিকেলের লাল আকাশ দেখতে দেখতে আমরা চারজন বাড়ি পৌঁছলাম।

সে-বার এডমান্টনে খুব বরফ পড়লো কিন্তু টরোন্টোয় একেবারেই নয়। শীতকাল সাদা বরফে চতুর্দিক ঢাকা না পড়লে কানাডিয়ানদের মন খারাপ হয়, দুশ্চিন্তা হয়। আবহাওয়া মণ্ডল আর ফসলের অনিশ্চয়তা! তবে, সব ঘটনাতেই আমার নতুন ইমিগ্রেন্টদের কথা মনে হয়- ঠান্ডা কম পড়ায়, তারা তো বাঁচল!

হোয়াইট এভিন্যু থেকে ঝিলামের স্কুল অনেকটা দূরে। খুব ঠান্ডায়, বরফের মধ্যে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়তে হয়,  হেঁটে যায় ইউনিভার্সিটির এল.আর.টি (Lower Rail Transit)স্টেশনে। কলকাতায় যা মেট্রো, টরোন্টোর তা সাব ওয়ে এবং ক্যালগেরী, এডমান্টনের এল.আর.টি। হাঁটতে দশ মিনিট, কিন্তু কনকনে ঠান্ডা, তুষারপাতের মধ্যে বাসের জন্য অপেক্ষা করে বাস ধরে যেতেও সেই দশ মিনিট। ট্রেনে কয়েকটা স্টেশন পরেই এডমান্টন ডাউনটাউনের সেন্ট্রাল স্টেশন, যেখানে ওর স্কুলসেন্টার হাইট্রেন থেকে নেমে আবার হনহন করে সাত-আট মিনিট হাঁটা।

টরন্টোর থেকে এডমন্টনে ঠান্ডা বেশী, শীতের স্থায়ীত্বও বেশী, কিন্ত্‌ এখানে টরোন্টোর লেকের জলে ভেজা, হাড় কাপানো হা হা করে তেড়ে আসা ঝড়টা নেই। শীতের সময়েও হঠাৎ একটা গরম হাওয়া (Chinook-সীনুক) এসে হাল্কা উত্তাপের প্রলেপ বইয়ে দেয় শীতের চরম কষ্টে হঠাৎ আচমকা বসন্তের মৃদু মধুর চুমা - একটু হাফ ছাড়া স্বস্তিও তা ছাড়া, এখানে জীবনের ছন্দটা একটু চেনা চেনা, টরোন্টোর মত দ্রুত নয়। ঝুমরিদের পাড়া, ইউনির্ভাসিটির কাছে - ১১১ এভিনিউ বা হোয়াইট এভিনিউ-এর ওপর। সেই রাস্তায় অনেক চায়ের আড্ডা, বই- মিউসিকাল ইন্সট্রুমেন্টের দোকান, স্টুডেন্টদের হাসি-গল্প; সবেতে বেশ প্রাণময়।

ঝুমরিদের যেহেতু দু’টো শোবার ঘর, ঝিলামের থাকার অনুমতি সহজেই পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু আমি এসে যাওয়াতে, স্কুলের কাছাকাছি অন্যএ ভাড়া-র খোঁজ শুরু হল ঝুমরি অনেক জায়গায় ফোন করে ঠিক করেছিল কবে কখন এপার্টমেন্ট দেখতে যাব। নিদারুণ ঠান্ডা আর চারিদিকে ধু ধু বরফ। একদিন বেড়িয়ে, বরফের পাহাড় ডিঙ্গিয়ে পর পর কয়েকটা বাড়ি দেখলাম। পরের দিনও মিশা গাড়িতে করে বেশ কয়েকটা বাড়ি দেখিয়ে আনলো, তার মধ্যে যে এপার্টমেন্টটা খুব পছন্দ হল, ছোট সুন্দর তিন তলা বাড়ি, সেটাই ৪ মাসের জন্য ভাড়া নিলাম, এই লেখার খসড়া সেখানে বসেই। মোট ছ’টা এপার্টমেন্টওপরতলায় একটায় সুপারভাইসার, অল্প বয়সী মেয়ে উরসুলা ও তার বয় ফ্রেন্ড আর একটায় আমরা থাকিএকতলায় লন্ড্রি রুম, সেখানে যেতে হয় কাচাকাচি করতে ভালো ব্যবস্থা। শান্তিপূর্ণ। ঝিলামের স্কুল সকালে। একটু বেলার দিকে ক্লাস থাকলে হেঁটেই চলে যাওয়া যায়। বাসে গেলে ৪-৫ টা স্টপেজ। কয়েক মিনিট পর পর অনেক বাস আসে। পাড়াটা ভালো, কসমোপলিটন - বড় রাস্তা খুব কাছে আর সেখানে একটা পেট্রল পাম্প/ গ্যাস-স্টেশন থাকায় নানা রকম লোকের ভীর লেগেই থাকে এদিকে অনেক বেশী বাদামী আর কালো চামড়ার মানুষ, টরোন্টোর মতো। আমাদের পাড়া আর ডাউন টাউনে অ্যাব-অরিজিনালদের ও দেখা যায়। 
      
এডমান্টন আমার টরোন্টোর থেকেও বেশী ভাল লাগছে। টরোন্টোর জীবনে বড্ড দৌঁড়দৌড়ি, ভীর, কাজের চাপ। মানুষগুলোকে হতে হয় মেশিনের মত। আজকাল অবশ্য সব দেশের সব বড় শহরেই এমনটা। বম্বে, ব্যাঙালোর, কলকাতা, দিল্লীর জীবনের যান্ত্রিকতাও আমাকে এখন আশ্চর্য করে। বড় দ্রুত যান্ত্রিক হচ্ছে নগর জীবন। পন্যদ্রব্য কিনে নিচ্ছে মানুষের অনুভুতি, মানব বোধ

মিশা ট্রাক ভাড়া করে এনেছিল। শনিবার সকালে ঝুমরিদের বাড়ি থেকে জিনিষপত্র ট্রাকে তুলে এ-বাড়ির তিন-তলায়তিন-তলা বাড়ি বলে এখানে এলিভেটর নেই। ঝিলামের ওপর ঘর গোছানোর ভার দিয়ে আমরা সারা বিকেল আর সন্ধ্যা ধরে দোকান বাজার করলাম। একদিনের মধ্যেই আমাদের এখানকার সংসার পত্তন হয়ে গেল।

রাতে খিচুরি, বেগুনভাজা, ওমলেট। খাওয়া দাওয়া সেরে ঝুমরিরা বাড়ি ফিরে গেল অনেক রাতে। ঝিলামও ঘুমেআমি টেবিলের ওপর দু-হাতের মধ্যে মুখ গুজে বসে থাকলাম অনেকক্ষণ। বুকের মধ্যে চাপ চাপ ব্যথা। এতক্ষণে যেন পরিস্থিতিটা মাথার মধ্যে ঢুকে আমাকে বুঝিয়ে দিল দেশের পরিবেশ বিশেষজ্ঞর চাকরী আমার মুঠো থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে, ঝাপসা হয়ে গেছে আমার ব্যক্তিগত এবং কর্ম-জীবন। সামনের তিন মাস অপেক্ষা করা আর খেয়াল রাখা ঝিলাম যাতে ঠিকমতো স্কুলে যায় - নিয়মিত ক্লাস, পড়াশোনা করে পরীক্ষা দেয় এবং ঠিকভাবে কলেজে ভর্তি হতে পারে। তার পরের ভবিষ্যত আমার অজানা। আমি হলাম ঝিলামের পথের সঙ্গী। আমি হাল ধরে থাকলেও সে পথ কোথায় যাবে, জানি না।
        
রাতে ঠিকমতো ঘুম হয়নি। ভোর রাতেই উঠে পড়লাম। ঐ ভোরেই আমি রান্নাঘরের জিনিশপত্র নিজের সুবিধা মতো গুছিয়ে, বড় এক কাপ চা বানিয়ে জানলার কাছে এসে বসলাম। চারিদিক বরফে সাদা। সমস্ত বাড়ির চালে, গাছের ডালে ডালে, পার্কিং-এর গাড়িগুলোয় মোটা বরফের আস্তরণ। ভোরের আলো ঠিক্‌রে বেরচ্ছে সাদা বরফে প্রতিফলিত হয়ে। বরফের মাঠ, বরফের গাছ, বরফের বাড়ি। দেখতে দেখতে কত যে ভাবান্তর হয়। বরফের সূক্ষ্ম কারুকার্য কখনো মোহিত বাক্যহারা করে দিয়েছে, কখনো বা নিজের ভেতরটাও ঠান্ডা, নির্জীব হয়ে উত্তাপের আকাঙ্ক্ষায় মুষড়ে থেকেছে। গরমের দেশের লোক, এরকম মাসের পর মাস বরফ দেখে, কঠিন শীতলতায় থেকে, বোধ হয় নিজের অগোচরেই অবসাদস্ত হয়।

আমি চির উদ্যমী তবুও গভীর অবসাদ বা শোকে ভাঙ্গা হৃদয় ২০০৪-এর শীতে। সে বছর ১ জুলাই মা-কে হারিয়ে কলকাতা থেকে কানাডায় ফিরেছিলাম শূণ্য হৃদয়ে, যেন কোনো পিছুটান নেই, কেউ ওখানে প্রত্যেকটা দিন আমার কথা ভাববে না, আমার ফোন আসার জন্য অপেক্ষা করবে না। দেশ, আপন মানুষজন, আমার ২০ বছরের সঙ্গী ‘জিওলজিস্ট প্রফেশন’ ছেড়ে দেবার এক বছরের মধ্যেই আমার সারা জীবনের সঙ্গী আমার মা আর নেই। যেন আমি-ই নেইএখানে ফিরে আসতেই পাতা ঝড়ার সঙ্গে, রিক্ত-শূণ্য-শীর্ণ গাছগুলোর করুণতার সঙ্গে, বরফের কঠিন উদাশীন শীতলতার সঙ্গে একাকার আমি। আজও বরফের দিকে চেয়ে হতাশ বসে আছি, সামনে জীবনের অজানা অধ্যায়।
       
রবিবার গেল সংসারের চাকা সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে দেখতে সব ঠিকঠাক চলছে কিনা। ঝিলাম অনেকক্ষণ আমার সঙ্গে সঙ্গে কাজ করলো। বাড়িটা যেন ওর মনের মত হয়েছে। মুখে হাসি। খাওয়া দাওয়ার পর পুরনো পাড়ায় গেল আড্ডা মারতে। বিকেল ছ’টায় ও ফিরে আসলো, রবিবারের ছুটি থাকায় ঝুমরি আর মিশাও এল। ঝুমরির বন্ধু মৃদুলা টিফিন কৌটো করে মালপোয়া বানিয়ে পাঠিয়েছিল। ইলিশমাছ আর এটা ওটা রান্না করেছিলাম। চারজনে খুব আনন্দ করে খেলাম। ওরা তাড়াতাড়ি চলে গেল, আমিও লেখা সাঙ্গ করে ঘুমোবার তাড়ায়। মেঝেতে, ঝুমরির দেওয়া দুটো ম্যাট্রেস  পেতে পাশাপাশি শুই- বেশ আরামে

গৃহ-পত্তনের পরদিন সকালেই দু’জনে মিলে পাড়াটা দেখতে বেরলাম। বাড়ির দু’দিক ৭-৮ ব্লক হেঁটে কোথায় কী আছে দেখে এলাম। এদিকের অনেক ছোটখাট দোকানই চালাচ্ছে, এশিয়ান আর সোমালিয়ান লোকেরা। সবজী, মাছ-মাংস, গ্রসারির জন্য কাছেই আছে বড় চায়না টাউন।

আমাদের বসার ঘরটা খোলামেলা পশ্চিমমুখী, তাই দুপুর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ঘর আলো করে রোদ থাকে। ঘরটা তখন কী উষ্ণ, আলোকিত, সুন্দর! বসার ঘরের সঙ্গেই একদিকের লম্বা দেয়াল জুড়ে রান্নার ব্যবস্থা, মস্ত বড়, টানা কিচেন ক্যাবিনেট। ব্যালকনিটা পশ্চিম দিকে। খুব সুন্দর। আমাদের শোবার ঘরও পশ্চিমমুখী, অনেকক্ষণ রোদ পায় বলে শীতের রাতেও বেশ উষ্ণতা থাকে।  খুব বড় বাথরুম - দক্ষিণের দিকে জানলা। বাথটবে গরম জলে সাবানের ফেনার মধ্যে অনেকক্ষণ ডুবে থেকে স্নানের বিলাসিতা- ঠান্ডার দিনেও।! এ-বাড়িতে আসার পর থেকে কাজ করতে করতে প্রিয় বাংলা গান শু্নি। ঝিলামও অনেক রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনিয়েছে। উচ্চ কন্ঠে সুকুমার রায় এর আবোল তাবোল আর পাগলা দাশু পড়েছি দুজনে- মুখস্তই বলা যায়। 

আর একটা দিন কাটল। মঙ্গলবার। ২৮ মার্চ-২০০৬পড়াশোনা, একটু ঘরের কাজ, স্নান খাওয়া সেরে ভর দুপুরে আমরা কে কখন লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। আজ আর দুপুরের আড্ডায় বেরন হল না ঝিলামের। বিকেল চারটেয় বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখি খুব সুন্দর, বরফ নেই, চারিদিক রোদে ঝলমলচা খেয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম হাঁটতে। আমার টুপী, মাফলার, গ্লাভস দেখে ঝিলাম হাসলো- ‘আমি ও সব পরবো না, আজ মনে হচ্ছে এক্কেবারে স্প্রীং’ও লেদার জ্যাকেট আর ফ্যান্সী জুতো পরে বেড়লো। হাঁটতে হাঁটতে ডাউন টাউন। ঝিলামের স্কুলের সামনেই কয়েকটা ব্লক জুড়ে সুবিশাল, চোখ ধাঁধান সিটি সেন্টার মল, মল পার হয়ে সেন্ট্রাল লাইব্রেরী। আমরা ঘণ্টা খানেক লাইব্রেরীর মধ্যে ঘুরে ঘুরে বই দেখলামফেরার পথে মলের ভিতরে ফুড কোর্ট থেকে শ্রিম্প স্যুপ কিনে ভাগ করে খেলাম। একটু অন্য পথে বাড়িদূর থেকে Mac. Ewen কলেজের মাথা দেখা যায়-চুড়ার মত; আমরা কলেজের সামনে দিয়ে বাড়ি ফিরলাম। খুব কাছেই আসলে, বাড়ি থেকে মাত্র দুটো ব্লক হবে। ঝিলাম হয়তো এই কলেজেই পড়বে এ-বছর সেপ্টেম্বর থেকে।

বাড়ি ফিরে রান্নার পাট ছিল না, অনেক খাবার ফ্রিজে। ঝিলাম ওর দায়িত্বমতো ভাত বানিয়ে পড়তে বসলো। আমার কয়েকটা ফোন এল টরোন্টো থেকে। অধিকাংশ নারী-পুরুষের মিত্রাদি আমি। শুধু লছমী ডাকে মিত্রা বলে। ঝুমরির বন্ধু তৃণাঞ্জনের মাসী হবার সুবাদে তৃণাঞ্জনের জানা সবাই, সুদীপ, শুভ, সঙ্গিতা, হৈমন্তি, মধুমিতা, ডাকে মিত্রামাসী বলে। শমিতা তো ঝুমরির-ই বয়সী। আমার প্রতি ছোটদের একটা ভালবাসা - হয়তো বিদেশ বিভূঁই-এ বারবার দেশের হাওয়া এনে দেওয়া, হাসি-ইে হুল্লোড়ের সঙ্গে সঙ্গে বিপদ আপদে ভরসা দেওয়ার একজন খোলা মনের মানুষ, ওদের আপন জন!
দিলীপ ওর কাজের শেষে রাত ন’টায় রোজ ফোন করে। এডমান্টন কানাডার পশ্চিম দিকে বলে এখানে সূর্যোদয় অর্থাৎ দিন শুরু হয় টরোন্টোর থেকে দু-ঘণ্টা পরে। তাই ঘড়ির কাটা, অর্থাৎ সূর্যোদয় অনুযায়ী টরোন্টো থেকে দু-ঘণ্টা পিছিয়ে। আমাদের ন’টায় ফোন এলেও দিলীপের তখন রাত ১১টা, কাজের শেষ। দেশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে আমিই ফোন করি। আপন দাদা দিদি - কেয়া, বিল্টু, অর্চনা, রুদ্র আর টুকুপিশি, গীতাপিশির সঙ্গে। স্কুলের বন্ধু দুর্গা, জিওলজির ক্লাস মেট, অফিসের বন্ধু, অনেকের সঙ্গেই কথা হয় মাঝে মধ্যে। সেই শৈশব, স্কুল জীবন থেকে কানাডায় চলে আসা পর্যন্ত কত লম্বা সময় কত ঘটনার মধ্যে দিয়ে যে আমরা একসঙ্গে কাটিয়েছি! আজ ওদের সবাইকে ছেড়ে, দেশ- চাকরী ছেড়ে এলেও মনে হয় আমার সঙ্গে ওদের একটা মানসিক বন্ধন রয়ে গেছে, একসঙ্গে পথ হাঁটা যেন এখনো চলছে – অথবা আমি-ই হইত নিজের তাগিদে জিইয়ে রাখি সে বন্ধনএদিকে কানাডায় গত ছ’বছর ধরে ঝিলামকে নিয়ে সবার সঙ্গে গান, নাটক, উৎসব-অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে বাংলা লাইব্রেরীর মাধ্যমে কত অচেনা মানুষ বন্ধু হল, কত পরিচিত মানুষ দূরে গিয়ে হারিয়েও গেল।

নতুন পাড়ায় এসে তিন-চার দিনের মধ্যেই আমি আর ঝিলাম সেন্ট্রাল লাইব্রেরীতে গিয়ে মেম্বারশিপ করে ফেল্‌লামআমি এখন কাজ খুঁজছি। লাইব্রেরী-এইচ আর ডি থেকে ফোনে বা নেট-এ ইন্টারভিউ-এর দিন ঠিক করছি। এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সী-তে নাম লেখাচ্ছি। প্রথম দিন কার্ড নিয়েই ওখানকার কম্প্যুটারে ইন্টারনেট খুলে অনেকদিন পর ই-মেল চেক করে খুব স্বস্তি!এডমান্টনে মিশা আর দুই কন্যা ছাড়া এখনো আমার কোন বন্ধু হয় নি, তাই আমার সামাজিক বিনিময় আপাততঃ ইন্টারনেট আর ফোনের দখলে। পরিচিত সামাজিক জগতের বাইরে এসে পড়ায়, নিজের মরিয়া একরোখা ভাব হঠাৎ স্তব্ধ!  নতুন অনেক কিছু ঘটছে, তৈরী হচ্ছে। অষ্টাদশী কন্যাকে নতুন ভাবে চেনা, বোঝা, তার সঙ্গে পথ হাঁটা আর আমার এই প্রাত্যহিক লেখার অবকাশ যেন একটা নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।

মার্চের শেষে হঠাৎ ঠান্ডা একটু কমল, সুন্দর ঝলমলে সকাল, বসন্তের হাতছানি-সবুজের মরিচিকা! টরোন্টো-য় ১৭ ডিগ্রী, কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে ওখানে। বাড়ি সুন্সান, ঘড়ির টিক্‌টিক্‌ শব্দ। মাঝে মধ্যে ফ্রিজ, হিটিং আর জলের পাইপ থেকে যান্ত্রিক আওয়াজ। জানলা দিয়ে গাড়ি চলাচল দেখছি, শব্দ কানে আসছে না - শুধু আকাশপথে হুশ্‌হুশ্‌ ডাকে প্লেন চলছেবরফ অনেকটা গলেছে, এখানে ওখানে টুক্‌রো টুক্‌রো বরফের চাঁই-চালার ওপরে, গাড়ির ছাদে একটু উঁচিয়ে, একটু ছড়িয়ে ছিটিয়ে। পাইন গাছে সারা বছর একটু আধটু পাতা থাকেই, পাতাঝড়া গাছেও এখন কচি সবুজ পাতার আভাস।

এখানে রাস্তা আর বাড়িগুলো-র বিন্যাস চৌকো গ্রিড প্যাটার্নে , এক একটি ব্লকে কয়েকটা করে বাড়ি আমাদের বাড়ির পিছনে, পশ্চিমের বারান্দার দিকে এই ব্লকটার কার পার্কিং। এক জায়গায় ময়লা ফেলার বড় বড় ভ্যাট।  এখানে, একা জানলার পাশে বসে দেখি অনেক বয়স্ক লোক বা যে কোন বয়েসের মহিলা জামাকাপর, টুকিটাকি জিনিষ, বীয়ারের খালি বোতল কুড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ওই বোতল দোকানে ফেরত দিলে পয়সা পাওয়া যায়। এখানে অনেকে ভিক্ষা চায়, সিগারেট, পয়সা। না দিলে অনেক সময়ে গালি-ও শুনতে হয়!

১ এপ্রিল থেকে কানাডার সব জায়গায় দিনের আলো অনুযায়ী ঘড়ির কাটা এক ঘন্টা এগিয়ে দেওয়া হল, দেশের সঙ্গে এখান থেকে এখন ১২ ঘন্টার তফাত, অর্থাৎ এখানে রাত ৯ টা মানে দেশে পরের দিন সকাল ৯টা। এখানে আজ ৭ ডিগ্রী, কলকাতায় ৪২। মারাত্মক গরম।

এদিকে আমি যে এত কাজকর্ম, দোকান বাজার, হাঁটাহাঁটি করছি তবুও রাতে ঘুম হচ্ছে না। ঘুম না হলেই বাস্তবের ঠিক না হওয়া অবস্থাগুলো মনের মধ্যে হয়ে ওঠে আরো কঠিন, জটিল। দিলীপ প্রায় রোজ ফোন করলেও, কানাডায় চলে আসার পরবর্তী জীবন ওকে ক্রমশঃ অচেনা, বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে, মাঝখানে কিছু নেই। মেয়েরা আর আমি দূরে থাকায় ও যেন নিজের জগতে, আমাদের সবার থেকে অনেক দূরে দিনশেষে ঘুমবার সময়ে গভীর এক অস্বস্তি, শুন্যতা অথচ মঙ্গল-আকাঙ্খার উৎকন্ঠায় ঘুম আসে না। ছেড়ে দিতে পারি না কেন যে!  ঝিলাম, প্রায় সব টীন-এজারের মত, কম ট্রাব্‌ল দিচ্ছে না। হেসে, নিজের সম্পর্কে বলে, ‘ডিফিকাল্ট চাইল্ড’ আর আমরাও এই ডিফিকাল্ট চাইল্ড সাম্লাতে না জেনে ওকেও ট্রাব্‌ল দিচ্ছি। নিজেকে কাউন্সেলিং করে  ওর সঙ্গে বন্ধুর মত গল্প, আলোচনা করি, নিজেকেও ব্যাস্ত রাখি ঘর আর চাকরির কাজে, অবসরে লিখি। লাইব্রেরী-র বইগুলো পরম বন্ধু, শান্ত করে আমাকে। ওকেও অবকাশ দিতে চেষ্টা করি নিজের মত থাকতে, বুঝতে।

আমি যে-দেশের, যে- সমাজ ব্যবস্থার, যে-সময়ের মানুষ;  আমাদের অনেকেই নিজের জীবনের মালিক হতে জানি না, নিজের পরিচয় বলে কিছু খুঁজে পাই না -- বিশেষ করে মহিলাদের জীবদ্দশা ভাগ হয়ে যায় কন্যা, ভগ্নী, স্ত্রী আর মায়ের ভূমিকায়। নারীর নিজস্ব জীবন, কাজ, দর্শন, উপলব্ধি, পরিসর, অলীক হতে থাকে নিজের তৈরী করা অতিরিক্ত পারিবারিক কর্তব্যের চাপ আর মায়ার বন্ধনে। জীবনে আনন্দ একমাত্র ঐ সন্তান সৃষ্টি ও সন্তান পালনের সার্থকতায়। কবে যে সেই দায়িত্ব শেষ হয়,  না- বুঝে সে নিজের কাছে, সবার কাছে নিয়ন্ত্রন-হারা অস্বস্তির কারণ হয়ে ওঠে, এ এক করুণ অবস্থা – ব্যাবহারিক অভ্যা্‌স, উৎকন্ঠা ও অসম্মানের চক্রাকার জীবন ! কাজ মাত্রেই হয়ে ওঠে নিরানন্দময়, কঠোর-কঠিন। তার নিজের আনন্দ, স্বল্প স্বাধীনতাও হয়ে যায় কল্পকথা! স্বপ্ন দেখতেও ভয়। মনুষ্য জীবন কোথায়? সে ধারণ করে, জন্ম দেয়, পালন করে, আজীবন রক্ষা করে চলে, ঠেলে এগিয়ে দেয়শুধু সন্তানকে নয়, স্বামী-পরিবার সকলকেএর বাইরে মানুষী শরীর, সূক্ষ্ম নরম স্বপ্নালু মন হাহাকার করেআমি চাই আমার দুই কন্যা এই সব পায়ের শিকল, খাঁচা ভেঙ্গে, এই গণ্ডী অতিক্রম করে নিজেদের ইচ্ছে আর যোগ্যতার জোরে মানুষের মত বাঁচুক

৪ এপ্রিল খুব সকালে লাইব্রেরী গিয়ে দেখি ৯ টায় খোলার অপেক্ষায় লোকে ভীর করে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক ৯টায় গেট খুলতে হুরমুর করে সবাই ভিতরে ঢুকল। অবাক হয়ে গেলাম যে লাইব্রেরীতে ঢোকার জন্য এত অপেক্ষা, তাড়া! একটু পড়াশোনা করে ধীরেসুস্থে এক কাপ কফি কিনে কয়েকটা ব্লক হাঁটতে হাঁটতে ‘এডেকো’ বলে এক এজেন্সী অফিসে পৌছলাম।  সকাল ১০ টা থেকে ১২টা পর্যন্ত আমার কম্প্যুটার আর রিট্‌ন টেস্ট হল, তার পর ইন্টারভিউ। আমি ৯০% নম্বর পেয়ে খুব তারিফ পেলাম আর এডমন্টন সান নিউসপেপারের ডিসিট্রিবিউসন-এ কাজের পোষ্টিং হল আমার। খুব আনন্দে জানালাম যে কাল-ই;  ৫ এপ্রিল থেকেই কাজ শুরু করব। আমাদের বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে, দু-বার বাস পাল্টে, প্রায় ৪৫ মিনিট-এর জার্নি। কিন্তু ভাল এনভায়রনমেন্ট, ভাল স্যালারি। শুরু হয়ে গেল আমার এডমন্টনের চাকরি। সকাল সারে ৭ টায় আমি আর ঝিলাম এক সঙ্গে বেরই, ওর স্কুল পর্যন্ত একসঙ্গে বাসে বা হেঁটে। লাইব্রেরী-র স্টপ থেকে আমার কাজের বাস ছাড়ে। ৯টা থেকে ৫ টা পর্যন্ত হাল্কা কাজ, ৬টায় বাড়ি ফিরি। চিরকালের স্বাবলম্বী আমি, এখানকার বাড়িভাড়া থেকে সব খরচ আমি নিজেই চালাতে পারব ভেবে আনন্দ আর গর্ব হচ্ছে!

রবিবার রাত, ৯ এপ্রিল, ২০০৬। রাত পৌনে নটা বাইরে এখনো সূর্যাস্তের শেষ আভা ছড়িয়ে ছিটিয়ে। পশ্চিমমুখী জানলা দিয়ে এসে, রোদ খেলা করছে ঘরের মেঝেয়। ঘরের আলো না জ্বালিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে বেশ লাগে! বাড়িগুলির মাথার ওপর গাছের ডালপালা - একটাও পাতা নেই, কাঁটা গাছ বা গাছের কঙ্কাল তার ওপরে গোলাপী আভার স্তর, গোলাপীর ওপর মায়াবী নীল, তারও ওপরে স্লেট রঙের আকাশ চিড়ে সূর্যকিরণ-  নেমে আসছে, মিলিয়ে যাচ্ছেরাস্তায় লোক নেই, চারদিক সুনসান, কার পার্কিং-এ গাড়িগুলো নিশ্চুপ হয়ে অন্ধকারে মিশে যাবার অপেক্ষায়। এ পাড়ায় দরিদ্র, গৃহহীন মানুষ, চেহারায়-পোশাকে দুর্দশার ছাপ - সকাল সন্ধ্যা আস্তাকুড় ঘেটে প্রয়োজনসামগ্রি খুটে বার করে- পর পর তিন-চারজনকে রোজ-ই দেখি। আজকাল কাজের জন্য সকাল বিকেল এই প্রিয় বারান্দা বা জানলার ধারে বসে চা খাওয়া আর হয় না। তবে, ঠিক তালে চলছে ঝিলামের স্কুল আর আমার কাজ, এটাই বড় আনন্দ। ক্লান্ত শরীরে ঘরের কাজ রান্নাবান্না করি, ও সাহায্য করে। স্কুলের পড়ার দিকেও এখন মন দিয়েছে, আমি পরীক্ষা নিইকাজের ক্লান্তিতে ঘুমবার সময় হাত-পায়ের মাস্‌ল্‌ শক্ত হয়ে থাকে, ঝিলাম ম্যাসাজ করে দিলে আরামে ঘুমাই। একদিন ঝিলাম কাঠের বড় চেয়ারটার অপর বাবু হয়ে বসে ওর লেখা ইংরেজী কবিতা আর একটা নাটক পড়ে শোনাল, আমি তো অবাক হয়ে গেলাম ও এত ভাল লিখতে পারে জেনে। ওর লেখা শুনে এ-ও বুঝলাম যে আমাদের পরিবারের চারজনকে ভীন্‌ দেশের জীবন চারভাবে প্রভাবিত করেছে, ওর মনের ভিতরে নানা রকমের চাপ। এর আগে ছোট ছোট স্কুলের অ্যাসাইনমেন্ট পড়ে তারিফ করেছি, ইংরেজী লিটারেচারে ভাল নম্বর পায় বরাবর। ছুটির দিনে ঝুমরিদের এপার্টমেন্টে গেলে রাতের খাবার একসঙ্গে হয়, কাল দুপুরে ওদের সঙ্গে খিচুরি, ধনেপাতার বড়া আর অ্যাসপারাগাসের চচ্চরি খেয়ে খানিক জিরিয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা ৭ টা থেকে রাত ১১ টা পর্যন্ত সবাই মিলে শুনে এলাম সাহিদ পারভেজ খানের সরোদ আর শশাঙ্ক-র বাঁশি,  মৃদঙ্গে ভি ভি নামমুর্তি। হয়ত ভালই আছিএই মুহুর্তে, নেই শুধু প্রেম। আছে কাজ, প্রাইভেসি, স্বাধীনতা, খানিকটা সন্তানসুখঅশান্তির সঙ্গে তাই শান্তি-ও। 
     
তবু, এই পয়লা বৈশাখ এসে যাওয়ায়, আম-কাঠালের দেশ, কালবৈশাখী আর ঝমঝম বৃষ্টি-র জন্য, ভাই-বোনদের জন্য মন কেমন করে। ফিরে ফিরে আসে অতি মধুর শৈশব। পয়লা বৈশাখে কত অনুষ্ঠান হত। আমাদের বাড়ির বারান্দায়, ঘরের মধ্যে। নজরুল মঞ্চে, টি ভি-তে টুকুপিশিদের সঙ্গে গান। রবীন্দ্রসদন, জোড়াসাকো-ই খুব সকালে বন্ধুরা মিলে গান শোনার আনন্দ! এই সব নিয়ে কত কী যে বিচিত্র স্বপ্ন দেখি! টরন্টো-র পরিবারগুলো-ও আপন হয়ে উঠেছিল, ছোটদের জন্মদিন, ২৫ ডিসেম্বর, ১ জানুয়ারী, সরস্বতী পুজো, দোল... আমাদের হৈ চৈ আড্ডা খাওয়াদাওয়া লেগেই থাকত। এ-দেশের ঠান্ডা বরফের দিনে কাজ পাওয়ার হা-পিত্তাসে দেশের জন্য মন কেমন করা কষ্টে আমাদের এই এক সঙ্গে থাকার আনন্দ প্রতিটি মনে উত্তাপের সঞ্চার করত। ছোটদের মুখে হাসি ফোঁটাতে পারলে আমাদের মাতৃহৃদয় জুড়াত।

এডমন্টনের আবহাওয়া এখন খুব ভাল। জ্যাস্পার, ভ্যাঙ্কুবারে বৃষ্টি হচ্ছে, সামনে গুডফ্রাইডে, ইস্টার উপলক্ষে ৪ দিনের ছুটি থাকলেও, ঝুমরির মতে,  বৃষ্টির আশঙ্কা নিয়ে নয়, মে মাসের ছুটিতে রকিস্‌ বেড়াতে যাওয়া ভাল। সুতরাং এডমন্টন-সান-কে জানালাম যে আমি ইস্টারের দিন কাজে আসব। আজকাল সপ্তাহে ৩,৪ দিন কাজ্জ থাকছে বলে সব দিক রক্ষা। বাসের পথ খুব সুন্দরবাড়ির দিক থেকে, ডাউন টাউন ছেড়ে, সাস্কাচুয়ান নদীর ব্রীজ পেরিয়ে অসমতল উঁচুনিচু ঢাল বেয়ে বাস চলে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেও নদী জমে বরফ হয়ে ছিল। এখন, এপ্রিলের মাঝামাঝি, দু এক জায়গায় একটু আধটু বরফের চাঁই। অগভীর জল

১৩ এপ্রিল, ২০০৬, রবিবার। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে বসার ঘরে এসে জানলার পর্দা সরাতেই চম্‌কে উঠলাম আর দৌঁড়ে গিয়ে ঝিলামকে ঠ্যালাঠেলি করে ঘুম থেকে তুললাম। থোপা থোপা বরফ ঝরে পড়ছে – চোখের ওপর চারদিক সাদা বরফে একটু একটু করে ঢেকে গেল। বসন্তকালের বরফে কী আনন্দ - সুখের দিনে, অসার হয়ে থাকা দুঃখের কথা মনে পড়ার মত এক ঝলক বিস্ময়! চা বানিয়ে দুজনেই জানলার ধারে বসে পড়লাম বরফ পড়া দেখতেঘন্টাখানেক পরেই পাগল প্রকৃতির বরফ গলান সোনালী রোদ - গাছের ডাল, বাড়ির ছাঁদ আর গ্যারেজের চাল বেয়ে টুপ্‌টাপ্‌ ঝরতে থাকা বরফ, এখানে ওখানে জমা জলের পকেট। ম্যাজিক!

গুড ফ্রাইডে-র ছুটি কাটল ঝিলামের সঙ্গে কবিতা পড়া, গান আর রান্নাবান্না-ঘরকন্নায়; ইস্টার-মানডে বলে বাস খুব কম থাকায়, সোমবার কাজে পৌছতে, ফিরতে অনেক দেরি । বাদবাকি সময়ে অ্যালবার্টা সোস্যাল সারভিস অফিসে পার্মানেন্ট, ভালো চাকরির দরখাস্ত জমা দিলাম - হল সারভিস-কাউন্সিলরের সঙ্গে ইন্টারভিউ। কিন্তু ওরা দিল যত বাজে কাজের অফার। তার চেয়ে সপ্তাহে তিন দিনের এই কাজ ঢের ভাল। এখানকার হিউম্যান রিসর্স, সোস্যাল ও্য়েলফেয়ার অরগ্যানাইজেসন গুলো ওদের নিজেদের লোকেদের-ই চাকরির সংস্থান। যারা কাজ খুজতে আসে তাদের সুরাহা হয় কিনা আমার যথেষ্ট সন্দেহ; হুয়ত প্রতিবন্ধি, অচল, বুড়ো মানুষেরা কিঞ্চিত মাসিক ভাতা পায়। এখানে অনেক মানুষের, মেয়েদের-ও, চেহারা, ভাষা, অভিব্যাক্তি এত ভয়ঙ্কর, দেখলে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হয় নিরাপদ দূরত্তে থাকার! অ্যালবার্টা উন্নত, ধনি, এখানে অনেক কাজ, এই তো শুনেছি; কিন্তু এদিকে, ডাউন টাউনের কাছেও দেখছি কত কর্মহীন, ভিখারি, পাগল, ক্রিমিনাল.... গৃহহীন, কর্মহীন মহিলা্রা অতি উগ্র, রাগী, কেমন যেন ডাকাত ডাকাত - সিগার-ড্রাগ-অ্যালকহল-মারামারি-প্রস্টিট্যূসনএদের অনেকে গ্রেড ৮ পাস করে দোকানে শ্রমের কাজ করে, স্টুডেন্ট-ও হতে পারে, অথবা অল্প বয়সে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সিঙ্গল মাদারজীবন আর সুখ-স্বাচ্ছন্দ কিছুতেই এক করা যায় না; সম্মানের প্রশ্ন অবান্তর। এরা অবশ্য মারামারি গালিগালাজ হম্বিতম্বি করে বেশ দাপিয়ে বেড়ায়। কঠিন ঠাঁই..সমঝে চল! ভাল! আমাদের অসহায় ছিচকাঁদুনে সতী সাবিত্রিদের থেকে ঢের স্বাধীন আর শক্তিশালী! 

২ মে। রাত সারে ৯টা। ২১ এপ্রিলের পর আর লেখা হয় নি। গত সপ্তাহে রোজ কাজ, তা ছাড়া অনেক রহস্য গল্প, টিন্টিন, অ্যাস্টারিক্স, গারফিল্ড, কেল্ভিন...ইত্তাদি হাল্কা বই-এ রিল্যাক্স। ঘরের পর্দা ফেলে আলো জ্বালিয়েছি, কিন্তু বাইরে এখন গোধূলির ক্ষীণ গোলাপি চ্ছটাবিকেলে ফ্রিজিং রেন হয়েছে, চারিদিকে জমে ওঠা জল। গরম পড়তে না পড়তেই ঠান্ডা ঝোড়ো-হাওয়া, তুষার বৃষ্টিআমাদের পশ্চিমের বারান্দার নিচে দুটো ধারি, ধুলোমাখা খরগোস ছুটছুটি করে, আজ দেখি এই ঠান্ডা হাওয়া, বৃষ্টির মধ্যে ব্যস্ত হয়ে মাটি আঁচড়াআঁচড়ি করছে দুজনায়। ঝুমরি ফোন করে খবর নিয়ে বলল, কাল ওরা আসবে, আমাদের নিয়ে বেরবে, গাড়িতে এদিকে ওদিকে ঘুরব, বাইরের দোকানে দোসা খাব আমরা - ও ড্রাইভিং টেস্ট দেবে, তাই নিজে গাড়ি চালাবে কাল।

আজকাল আমার লিখতে ইচ্ছে করে না, ক্লান্তি এসেছে লেখাতেও। আমরা যে টেবিলে বসে বই পড়ি, ল্যাপটপে কাজ করি, খাই; সেখানেই পড়ে থাকে আমার লেখার খাতা, উল্টোপিঠটা চোখে পড়ে, মন খচ্‌খচ্‌ করে, তবুও ইচ্ছে করে না, ইচ্ছে করলেও লিখতে পারি না। কাজে যাই, কাজ থেকে ফিরে ঘরের কাজ থাকে, ক্লান্তি আর ঘুম কাবু করে ফ্যালে। বই নিয়ে পড়তে পড়তে ঘুম। আমার জীবনে আমি যেন ট্যুরিষ্ট, এক পর্ব থেকে অজানা পর্বের ট্র্যানসিট ফেজের মধ্যে দিয়ে চলেছি, কিন্তু এটা পরিবর্তন, চলন, না আটকে থাকা এই চাপ আমার মধ্যে অকারণ এক উদবেগের বাষ্প তৈরি করে যা আমাদের দুজনের জন্যই যে ভাল নয় সেই বোধকেও ছাপিয়ে যায়।  

গরম পড়েছে। ১১ মে থেকে প্রত্যেক দিন কাজ। হাল্কা টি শার্ট পরে কাজে যাচ্ছি। সবুজ চতুর্দিকে...রাস্তার দু ধারে সবুজ গাছের সারি, হেঁটে চলার পথের পাশে সবুজ ঘাস, হলুদ ঘাসফুল, গাছে গাছে সাদা, বেগুনি থোপা থোপা ফুল, ছোট ছোট পাখি উড়ে বেড়ায় ফুরুত্‌ ফুরুত্‌, খরগোস-কাঠবেড়ালী দৌঁড়ে বেড়াচ্ছে। রাত সাড়ে নটার সময়েও সবুজ গাছ ঠিক্‌রে সোনালি রোদের ঘন আলো।

২২ মে আমার জন্মদিন, এই সময়ে ভিক্টরিয়া ডে-র জন্য লং উইকেন্ড-এর তিন দিন ছুটি। সামারে কানাডা সবুজে, ফুলে ঝল্‌মল্‌ করে, আমরা প্রত্যেক বছর-ই কোথাও বেড়াতে যাই। গত সপ্তাহে এক দিনও কাজ ছিল না। ছুটি নিয়ে দিলীপ এল মল্টন থেকে, আমরা পাঁচজন ব্যান্‌ফ্‌ বেড়াতে গেলাম। অপুর্ব সুন্দর পাহাড়ী রিসর্ট, পেইন্টিং-এর মত। তিনটে দিন বড় ভাল কাটল অরন্যের মধ্যে, নদীর পাড়ে, পাহাড়ে হাইকিং করে, খেয়ে ঘুরে বেড়িয়ে। যদিও, আমাদের হিসেব ভুল প্রমাণ করে রোজ-ই বৃষ্টি হইয়েছে, যাত্রা শুরুই হয়েছে বৃষ্টির মধ্যে আর প্রথম সন্ধ্যায় পৌছে রেসর্টের ভিতরেই থাকতে হয়েছে তুমুল বৃষ্টির জন্য। সকালে চোখে ফুঁটে উঠল অপরূপা ব্যান্‌ফ্‌ সহর। রাতে আলো ঝল্‌মলে ব্যানফ যেন আদরের দুলালীপাহাড় নদী গ্লেসিয়ার লেক, গিরিখাত, ট্যুরিস্ষ্টের ভীর দোকান পসরা মনে করিয়ে দেয় আমাদের দেশের কাশ্মীর, মানালি, সিকিম-এর অপূর্ব  জায়গাগুলো। বান্‌ফ্‌ যাবার পথে, রকি পাহাড়ের গায়ে অসংখ্য পার্মানেন্ট গ্লেসিয়ার আর নিচে নামতে থাকা মুভিং গ্লেসিয়ার দেখলাম! এল্ক, মাউন্টেন গোট, রেড ডিয়ার।  এদিকে আমরা আগেও কয়েকবার বেড়াতে এসেছি জ্যাস্পার, লেক লুইস, কেন্‌মোর, সাস্কাটুয়ান রিভার ক্রসিং-- সারা জীবন মনে রাখার মত সুন্দর! লেকের জল এত স্বচ্ছ যে মনে হয় জলের মধ্যে পাহাড়গুলো গা ঘেষাঘেষি করে ডুবে রয়েছে আর আমাদের দিকে অলৌকিক ভাবে তাকিয়ে আছে, কেমন গা ছম,ছম, করা নতুন ভাললাগা। ২২ মে দুপুরে উপাদেয় থাই ফুড খেয়ে এডমন্টনের দিকে যাত্রা – বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত। গাড়িটা আমরা ২৩ মে বিকেল পর্যন্ত রাখায় পর দিন সকালে এডমন্টন সহর দেখা হল দিলীপের। কিন্তু বৃষ্টির জন্য তেমন ঘোরা হল না।   

মে মাসের শেষ দিকে আকাশ মেঘলা, বৃষ্টি হচ্ছে মাঝে মাঝে। ঝিলাম এখন বসার ঘরে নিয়ে এসেছে ওর ঘুমোবার ম্যাট্রস, সেখানে বসে ওর লেখাপড়া। আড্ডা মারতে বেরিয়েছে-ও ফিরলে একসঙ্গে ডিনার হবে। ওভেনে পম্ফ্রেট মাছ, ব্রকোলি, ভুট্টা আর আলু বেক করছি। মেঘ আর রোদের লুকোচুরি খেলা চলছে বিকেল থেকেএকটু আগে আমাদের বারান্দায়, দেয়ালে, ঘরের মেঝেয় লুটপুটি করছিল রোদ্দুর- কিন্তু হঠাৎ কেমন মিইয়ে গিয়ে মন খারাপ করা ঠান্ডা, নিভু আলোর আভাস। কষ্ট নিয়ে বারান্দায় এসে আকাশের দিকে চেয়ে দেখি, আঃ! পশ্চিম কোণে মেঘ চিড়ে গোলাপি আভা মাখান মধুক্ষরা সোনালি আলো সেখানেই জমে আছে মনের আনন্দ, ভরসা, স্বপ্ন। একটু একটু করে আমার মাথা, মুখ হাত, বুক ভাসিয়ে স্বপ্নালু রোদের আদর...অনুভব করলাম, বারান্দায় রোদের মধ্যে দু হাত ডানার মত মেলে দিয়ে সত্যি সত্যি নাচ করলাম! ৯টায় ঝিলাম এল। চেখে দেখি, পম্ফ্রেট রোস্ট সুবিধের হয় নি। পেয়াজ-রসুন-টমেটো দিয়ে ঝোল বানিয়ে খেতে বসলাম।

দিলীপ চলে গেছে সেই বুধবার। ছুটি শেষ সবার। বৃহস্পতি-শুক্র থেকে আমার প্রয়োজন পড়েছে সান-এর ডিস্ট্রিব্যুশন ছাড়াও জি ই সিক্যুরিটির হয়ে ইউনিভারসিটি অব অ্যালবার্টা-র ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেম মেনটেনেন্স টিম-এ। আমার কাজ স্রেফ কন্ট্রল রুমে বসে হেড ফোন কানে লাগিয়ে চেক করা, উত্তর দেওয়া আর প্রয়োজনীয় সুইচ অপারেট করা। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টে, মাঝে যথারীতি লাঞ্চ আর টি ব্রেক। সম্পুর্ণ জুন মাস এখানেই আসতে হবে, টাকাও বেশী।

টাকার চিন্তা নেই। তাহলে? আমি কী, আমার কী প্রফেসন, নিজের জন্য গভীরে একটা অসহায় কাতরতা? সমস্ত অস্তিত্ব উদ্গ্রীব হয়ে থাকে নিজের পছন্দমত্‌ জীবনের জন্য ঝিলামের স্কুল পার হয়ে কলেজের পথে পা বাড়ান পর্যন্ত আমারো প্রতিনিয়ত এই লড়াইখুব ব্যাক্তিগত কী হারিয়ে যাচ্ছে, ভেঙ্গে যাচ্ছে, চিরতরে পরাহত, আমি টের-ও পাই না। যার শেষ নেই, অনন্ত, আমি-ই মধ্যপথে তার শেষ দেখে ফেলার বা বোঝার কে?

৩ জুন, শনিবার সকাল এসেছে উজ্বল রোদ, সবুজ পাতার আর ঘরের মধ্যে ঠান্দা হাওয়ার শিহরণ নিয়ে।সূক্ষ ডানা মেলে ফুলের রেনু উড়ে বেড়াচ্ছে, সাদা হলুদ প্রজাপতির মত। বাড়ির পিছনের পার্কিং-এ ঝকঝকে টিউলিপের গাছ। সামনের রাস্তার দু ধারের বিশাল বড় গাছগুলি দু পাশ থেকে লম্বা ডাল বাড়িয়ে পরস্পরকে আলিঙ্গণ করে তোরণ বানিয়েছে। ইউনিভার্সিটির জন্য জি ই সিক্যুরিটির কাজে যাই, সুন্দর বিশাল ক্যাম্পাস, স্টুডেন্টদের ব্যাস্ত ভাবে আসা যাওয়া, এক্টু হাসি আর কথা বিনিময়, বেঞ্চে বসে আপন মনে বই পড়া, সব বড় চেনা চেনা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কেমন একটা বিনীত, আত্মবিশ্বাস আর আশার হাওয়া নিঃশব্দে তরঙ্গিত অয়, দোলা দেয়

আমাদের ৪ জনের টিম, সকালে বাস টার্মিনাসের টিম হর্টনে মীট করে কফি-ব্রেকফাস্ট, তার পর ক্যাম্পাসে ঢুকে কাজে লেগে পড়া, এক বিল্ডিং-এ দ্বিতীয় দিন গেলে কোন স্টুডেন্ট বা টীচার চিনতে পেরে হাসে, দু একটা কথাও হয়। আমি জেন-এর সঙ্গে একটা গাড়িতে ঘুরে কাজ করি - অন্য দুজনের সঙ্গে লাঞ্চ আর টি ব্রেকে মিলিত হই। কাজের শেষে, বিকেল চারটার খা খা রোদ্দুরে জেন আমাকে ঝুমরিদের অ্যাপার্টমেন্টের কাছে ড্রপ করে দেয়। বড় মেয়ের সঙ্গে একটু গল্প করে আমি আমার ডিফিকাল্ট কন্যাকে নিয়ে উৎকন্ঠা-চাপমুক্ত হই!

খুব গরম পড়েছে। বৃষ্টিও হচ্ছে না আর। সকালে ২০ ডিগ্রী হলেও দুপুরে ৩২, ৩৫ ত হচ্ছেই! রাতে ঘুমোবার সময় বেশ গরম লাগে। বাড়ি ফিরে বাথ টাবে হাল্কা গরম জলে নানা সুগন্ধী সাবান, তেল বা সল্ট মিশিয়ে চোখ বুজে এলিয়ে থাকি অনেকক্ষণ, তার পর শাওয়ারের নিচে মাথা ভিজিয়ে স্নান করে উঠে খুব আরাম লাগে, ক্লান্তিমুক্ত হই!

৫ জুন, সোমবার, কাজ শুরু। সকাল ৬-৩০ এ আলার্ম শুনে ৭-২০ র মধ্যে বেরিয়ে পড়ি ইউনিভার্সিটি-র কয়েক স্টপ আগে বাস পাল্টাতে হয়, হেঁটেও পার হই কখনো, ঝুমরির বাড়ি বাঁ দিকে রেখে। দুপুর সাড়ে ৩ টেয় বাড়ি ফেরার বাসে উঠে গল্পের বই খুলে বসলাম আরাম করে, হঠাৎ বাসের সামনের বড় কাচের জানলার দিকে চোখ পড়তেই মোহিত হয়ে গেলাম দু দিকে দুই সারি সবুজ গাছের তোরণের পিছনে সম্পূর্ণ অন্য নীল রঙের আকাশ, কেমন একটা অদ্ভুত নতুন আলো, ঠিক যেন সত্যি নয়। সেই রঙ আর আলো দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে।ডাউন টাউনে বাস থেকে নামতেই গালের ওপর দু-চারটে বৃষ্টির ফোটা আর পিছন থেকে প্রবল ঝড়ের ধাক্কায় ফুটপাথ থেকে দড়াম করে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। তাড়াতাড়ি পিছিয়ে গিয়ে আবার ফুটপাথে উঠতে গিয়ে টের পেলাম হাওয়ার কত শক্তি হতে পারে, মনে হল দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না, ছিট্‌কে পড়ব বা উড়েই যাব।। সামনের ল্যাম্প পোস্ট জড়িয়ে ধরতাম হয়ত, এমন সময়ে সিগ্‌নাল সবুজ হল, দৌড়ে রাস্তা পেরলাম। বাস পেয়ে গেলাম। ঠান্ডা ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যে বাড়ি ঢুকতে বৃষ্টি এল।

অনেক দিন পর খুশী খুশী লাগছে। আমার আর ঝিলামের কলকাতা যাবার টিকিট হয়েছে, ৩ জুলাই টরন্টো থেকে প্লেনে উঠব, পৌছব ৪ জুলাই। খুব উত্তেজনা। স্কুল পর্ব শেষ হতে চলেছে। মাঝে আর এক সপ্তাহ। তার পরেই গ্রেড টুয়েল্ভের ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবে। কলেজে ভর্তির ফর্ম নেওয়া হয়েছে। ভর্তি হবার সময়ে মার্কশীট আর টাকা জমা দিয়ে, সাবজেক্ট ঠিক করে জানাতে হবে। সে কাজ করে দেবে ঝুমরি।  ক্লাস শুরু হবে সেপ্টেম্বরেআমি অ্যাডকো-কে জানিয়েছি আর দু সপ্তাহ কাজ করব। এবার এই ফ্ল্যাট ছেড়ে দেওয়া, টরন্টো হয়ে দেশে ফেরার পালা!

১১ জুন, রবিবার সকাল। আকাশে কাল মেঘের ঘনঘটা। কাল রাত ৯টার পর রীতিমত দুর্যোগ, আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি। এখন অবশ্য দু এক ফোঁটা ঝরছে।  দুপুরে মেঘ আর রোদ্দুরের লুকোচুরি, তার মধ্যে খাওয়াদাওয়া সেরে বার বার ওপর নিচ করে আমাদের লন্ড্রি হল, শীতের জামাকাপর কোট সোয়েটার, এখন থেকে বাক্সে গুছিয়ে রাখতে হবে ২৯ জুন টরন্টোর প্লেন ধরার জন্য, যাবার আগে বাড়ীর চাবি দেবার আগে পরিষ্কার ঝক্‌ঝকে করে রাখতে হবে মেঝে, দেয়াল, ওভেন, ফ্রিজ। চাবি নেবার আগে ওরা দেখে যাবে আপার্টমেন্ট - যদি পরিষ্কার না থাকে, ডিপোসিট থেকে কেটে নেবে ক্লিনিং-এর খরচ
সারা দিন বাইরে বৃষ্টি আর ভিতরে আমার কাজ, ঝিলামের পড়াশো্না, আমাকে সাহায্য। কাজের শেষে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম,  ঘুমের মধ্যে  ঝড়ের স্বপ্ন দুর্গাপুরে ঝড়ে আম বাগানে টপ্‌টপ্‌ করে আম পড়ছে, দিলীপের ফিল্ডের জন্য আমরা গেস্ট হাউসে –আম পড়ার শব্দে আমি ঝুমরি আর ঝিলাম দৌঁড়ে বাগানে গিয়ে আম কুড়চ্ছি। দিলীপ, অফিসের ভাস্কর চ্যাটার্জী আর অতনু চ্যাটার্জী বারান্দা ছেড়ে নেমে এসেছে বাগানে। আধো-ঘুমে জাগরণে ছিলাম, আসলে তখন সত্যি-ই ঝম্‌ঝম্‌ করে বৃষ্টি-র শব্দ শুনছি। জানলার ওপর বড় বড় জলের ফোটা – অদ্ভুত শব্দে, যেন কেউ ঢিল ছুড়ছে আমাদের জানলায়।

সেই মে-র শেষ থেকে সপ্তাহে অন্তত তিন দিন করে বৃষ্টি চলছে। কোথায় রাত দশটা পর্যন্ত আলোময় আকাশ, রোদে ভেসে যাওয়া পৃথিবী দেখব, সেই আলোতে বারান্দায় বসে গল্পের বই পড়ব বা লিখব অথবা হাঁ করে নানা রঙ্গে পেইন্ট করা পশ্চিম আকাশ আর তার নিচে গাছের সারির মুহুর্মুহূ রঙ পাল্টান দেখব, সে গুড়ে বালি!

তবে, আজকের বৃষ্টি বড় সুন্দর, বিকেলে ঝুমরি আর মিশা এসেছিল- অদ্ভুত নীরবতায় জানলার কাচে চোখ রেখে বৃষ্টির ক্ষ্যাপা রুদ্র-রূপে মুগ্ধ আমরা! সব শান্ত হলে, বারান্দায় বসে গান শুনছিলাম;  হৈমন্তি আর মধুমিতা ফোন করে জানাল ওরা মনস্থ করেছে এখানকার পা্ত্‌তাড়ি গুটিয়ে দেশে ফিরে যাবে। দেশে ওরা ছিল প্রতিষ্ঠিত, এখানকার দুঃসহ ক্লাইমেট আর যান্ত্রিক জীবনে ওরা হাপিয়ে উঠেছে, ওদের পরিস্থিতিও খাপ খাইছে না এই দূর পরবাসে! দেবাহূতি, আশোক-রা টরন্টোয় মনমত কাজ না পেয়ে এসেছে  আমাদের কাছাকাছি, অ্যালবার্টা-র ক্যালগেরি-তে।

৭ জুন, জ্বরে কাবু ওসুধ খাচ্ছি। গত তিন দিনের বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ঘোরাঘুরি করে ঝিলামের চোখ দুটো ফূলে আছে, ক্ষিদে নেই, কোন রকমে দুজনে চা আর টোস্ট বানিয়ে খেলাম। একটু একটু রোদ উঠছে, গরম-এর আভাস। বাড়ির নিচের চাতালে বৃষ্টি ভেজা আপেল গাছে ফুল এসেছে, ম্যাগপাই, রবিন রেড ব্রেস্ট –এর আনাগোনা।  

১৮ জুন। কালো মেঘের দাপট, হাওয়ার ফিস্‌ফিসানি-র সকাল কে কোন্‌ ঠাসা করে উজ্বল আলোকিত দিন,  বিকেলে মিষ্টি হাওয়ায় রোদের গরম ওম, লাইব্রেরী থেকে বই-এর বোঝা পিঠে ফেলে হন্‌হন্‌ করে মহানন্দে বাড়ি ফিরলাম, মাংস রান্না হল। আজ ফাদার্স ডে। ঝিলাম তার বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বলল, আমি শুনলাম আমার বাবার স্বকন্ঠে কবিতা পড়ার ক্যাসেট, নচিকেতা। গত মাসের ৩১ তারিখ আমাদের মুখোমুখি আপার্মেন্ট থেকে চলে গেছে উরসুলা আর অ্যাডাম, এ মাসের প্রথম দিকে ওই ঘরে এসেছে মাইকেল নামে এক যুবক, তার মা আর ভাই এসেছিল ঘর গুছিয়ে দিতে, আলাপ করে গিয়েছিল আমাদের ঘরে এসে। ছেলেটা এখন একা থাকে, আসতে যেতে দেখা হলে মিষ্টি হাসে। নিচের তলায় যে চাইনীজ ছেলে আর মেয়েটা থাকে, খুব ঘটা করে, ঘর সাজিয়ে, অনেক অতিথি-খাওয়া দাওয়া, উপহারে তাদের বিয়ে হল এ মাসেই।

২১ জুন কানাডায় অফিসিয়াল সামার। রবিন পাখির আনাগোনাতেই নাকি সামার এসেছে বোঝা যায়। আর সত্যি-ই আমাদের বাড়ির  চাতালে আজকাল রবিন দেখি, ডাক শুনি।  সকালে ঘুম ভাঙ্গে নানা পাখির কিচিরমিচির শব্দে, অনেক চড়াই ঝগড়া করে;  বিশেষ করে, ম্যাগপাইগুলো কোলাহল বাধিয়ে দেয়। একটু পরে, ঝলমলে দামাল রোদ এসে ঝাপিয়ে পরে আমার খাতায়, লেখার ওপর। রাত সাড়ে দশটার পর সুর্যাস্ত। খুব গরম। রাতে একটানা ঘুম হয় না, আর একবার স্নান করতে ইচ্ছে করে। এখানে পাখা নেই, আমাদের তো এবার যাবার পালা, গোছান শুরু হয়ে গেছে। শুরু হয়েছে লাইব্রেরীর বই, স্কুলের বই ফেরত দেওয়া। সময় পেলে সিটি সেন্টার মল থেকে কোলকাতার জন্য উপহার কিনে আনছি। ২৬-২৮ জুন ঝিলামের গ্রেড ১২-র  শেষ তিনটি ফাইনাল পরীক্ষাভালই হচ্ছে। শেষ দুই মাস ঠিকমত ক্লাস, পড়াশোনা করেছে। ঘর বাথ্রুম রান্নাঘর পরিষ্কার করে, কিছু জামাকাপর হাতে কেচে,  হাতে খুব ব্যাথা, শরীরে এত ক্লান্তি যে প্রায় অর্ধেক চোখ খুলে লিখি২৮ তারিখ ঝিলামের পরীক্ষা শেষ হলে ঝুমরি আর মিশা আসবে, আমরা ৪ জন মিলে আপার্ট্মেন্ট পরিষ্কার করে সব কিছু প্যাক করে ফেলব, নিজেদের জামা কাপড়ের তিন-চারটে স্যুটকেস ছাড়া ঝুমরিদের বাড়িতে প্রায় সব জিনিষ ফেরৎ যাবে

২৯ তারিখ ভাড়া-র গাড়িতে মালপত্র তুলে এ-বাড়ি থেকে বিদায়।


ছোট ছোট আসবাবপত্র, ফুলের টব, গাছপালা-পাখি-ফুল, আমার সারা দিনের সংসার, কাজের পৃথিবী, সুর্যাস্তের আলো, ঝিলামের অপেক্ষায় রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার উৎকন্ঠা আর রক্ত চাপ বাড়তে থাকা, মেয়েদের সঙ্গে অনেক আনন্দের মুহূর্ত - সব ছেড়ে দিয়ে চল আবার। বিদায় এডমন্টন! বিদায় সিক্সথ স্ট্রীট, হোয়াইট এভিনিউ, বিদায় এডেকো-  সেন্টার হাই স্কুল আর লাইব্রেরি!


No comments:

Post a Comment