শিকড় সন্ধান – দেশে বিদেশে
অন্তরা কর ও অপরাজিতা সেন
সাউথসিটি, কলকাতা
একটি অতিকায় মুদিখানা দোকানের (রিটেল শপ) এক নিভৃত কোণায় মন দিয়ে লো ফ্যাট
বিস্কুটের গুনাগুন পড়ছি, কানে এল ঐতিহাসিক কথোপকথন :
‘সারাদিন হাইজিন হাইজিন কোরো না তো - এই তো দেশে এলাম কটা মাসের জন্য- একটু রুট টা ফিল করতে
দাও। বেশ জমিয়ে কটাদিন পোস্ত সর্ষেবাটা খাব, সেই মা বানাতো ছোটবেলা- উফ্ গরম ভাতে কি অসাধারন।‘
(বিরক্তিসূচক শব্দ) ‘তোমার রুট ফিল করতে গিয়ে সেবার দুদিন ORS
খেয়ে কাটাতে হল। কি যে হয় না তোমার- আসছো তো বছর বছর - কি
যে তোমাদের আদিখ্যেতা রুট নিয়ে । দেশে পা দিতেই হা হা করে আনহাইজিনিক খাবারগুলো
খাবে আর পাঁচশ বার দেখা কলকাতা চষবে। তাতেও মন ভরবেনা। ফেরার সময় সারা ফ্লাইট প্যানপ্যানে মুখ করে
থাকবে- অসহ্য বাতিক তোমাদের।‘
কৌতুহল চাপতে না পেরে উঁকি দিলাম। শিকড়বাবু যারপরনাই NRI-
পরেন বারমুডা ও নাইকী জুতো,
হাতের আঙুলে গোমেদ ও পলা,
জামায় ঝুলন্ত রে ব্যান,
হাতে পিকসেলের আনকোরা মডেল। মিসেস বেশ পরিপাটি,
বিলাসিনী । শিকড়বাবুর উপর যথেষ্ট বিরূপ। আরো শুনব বলে পিছু
নিলাম ।
‘হুঁ হুঁ বাওয়া বুঝবে না। তুমি রায়পুরের প্রবাসী,
দেশের টান তুমি কি বুঝবে?
নর্থ ক্যালকাটার রুট টা অনেক ডীপ ..’
(নাক টেনে) ‘হ্যাঁ, সারাজীবন তো ঐ পিছনে বাঁশ আর বগলে ইতিহাস বয়ে বেড়ালে... ‘
(একগাল
হেসে) – ‘এটা
"বুনোহাঁস" এর ডায়লগ .. ‘
‘I found it so
true .. honestly - am sick of this root stuff of yours’
‘Relax. আরে তুমি তো জানো , কলকাতায় আসলেই কেমন যেন সব nostalgic
লাগে। মনে হয় মার হাতের রান্না খাই,
দেবুদের সাথে হেদুয়ার আড্ডা,
গোলবাড়ির কষা মাংস , কফি হাউসের কাটলেট - একটা ব্যাপার আছে জানো... ‘
জানার আগেই মিসেস এগিয়ে গেলেন বিলিং এর দিকে।
আমার মাথায় ঘুরছিল এই শিকড়বাবুর কথা। অনেকদিন বাইরে থাকলে দেশের জিনিস অন্যরকম
লাগে, যে
সব অসুবিধাকে শাপশাপান্ত করতে করতে একদিন দেশ ছাড়া,
সেগুলোই স্মৃতিচারনে নতুন করে পাবার স্পৃহা নিয়ে ফিরে আসে।
মায়ের হাতের ডাল-ভাত একদিন অখাদ্য মনে হত, আজ সেটা পেতেই হেদিয়ে মরা - এটাই কি শিকড়ের টান ?
আমার জন্ম -ধর্ম-কর্ম সবই কলকাতা, না দেখেছি দেশভাগ, না বুঝেছি পরবাস। এহেন নিশ্চিন্ত নিরীহ জীবনযাপনে শিকড়রের
টান অনুধাবন করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। কিন্তু যতবার ভেবেছি ততবার মনে হয়েছে বিলেতে
বসে মোচার ঘন্ট খাওয়ার আকাঙ্খার থেকে শিকড়ের টান প্রতিপন্ন হয়না। শুধু nostalgia
র সার্ফিং বোর্ড চড়ে যখন তখন শিকড়ের টানে ডাইভ মারলে
প্রবাসী হওয়া সার্থক হয়না। এর মানে আরও গভীর। মানুষ তো কখনও গাছ হতে চায়না- গমন
তার অহংকার, গতি তার জীবনের পূর্ণতা আনে- তবে কেন শিকড় নিয়ে এত টানাটানি। বুদ্ধিজীবীরা বলে
মানবজাতির উত্থান নাকি ঐ শিকড়ের ভিতর - বাবা রামদেব ও তাই উঠে পড়ে লেগেছে সব
শিকড়কে নিংড়ে সব উত্থান বোতলবন্দী করতে। এই অধরা অনুভূতিকে সামনে রেখে বানিজ্যিক
ভাবে সব টান উসকে দেবার ব্যবস্থাও দেদার। বঙ্গ থেকে বঙ্গ সম্মেলন উঠে গিয়ে পড়ল
পশ্চিমের সাগরপাড়ে। সেখানে আগে দূর্গাপুজো হত শুধু - এখন শিতলা,
সত্যনারায়ন, ইতু সব পালন। টান উঠলেই অনলাইনে সব হাতের মুঠোয়। সত্যি
সত্যি কজন ভাবে নিজেদের রুটস নিয়ে? মন থেকে কজন ফিরে আসতে চায়?হাতের কমফর্ট পায়ে ঠেলে, নিজের
সাধ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে চলে আসতে পারে?
প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা।
বিদেশে
‘Mom, can I go
out tonight, please? I have finished all my homework’
চোখ তুলে দেখি মেয়ে বাইরে যাবার জন্য একদম তৈরী। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ
পর্যন্ত সাজ সম্পূর্ণ। চোখের পাতায় ঘন মাসকারা,
ঠোটে ঘন লিপস্টিক| জামাটার কথা আর নাই বা বললাম|
কতক্ষণ ধরে সাজ হচ্ছে কে জানে|
হোমওয়ার্কই বা শেষ হল কি করে ! হাতে নতূন পূজোবার্ষিকিটা
এসেছে আজ। তাই তেমন মন দিতে পারিনি অন্যদিকে। কটমট করে তাকাই মেয়ের দিকে।
‘কাল তোমার স্কুল আছে না?
এখন আটটা বাজে। এখন বেরিয়ে কখন ফিরবে শুনি?
আর এই সাজে বাইরে যাবে?
এই জামাটা এলো কোথা থেকে?
‘Mom, I’m not a kid anymore.’
‘বাঙলায়
কথা বল। বলেছি না বাড়িতে ইংরিজি বলবে না আমার সাথে?
না কি আজকাল খুব অসুবিধা হয় বাঙলা বলতে?’
‘Ma, cut it out.
বাঙলা বলতে গেলে তো একটু ভাবতেই হয়। I
don’t have so much time. যাব
কি না বল’
‘না যাবে না। কার জামা পড়েছ বললে না?’
‘Uffff, Nita
lent it to me. I really dig this dress, Ma. Please let me go.’
‘যতদিন এখানে আছ ততদিন বাড়ির নিয়ম মেনে চলতে হবে তিতির। বাবা
কি বলবেন একবার ভেবে দেখেছ? এই রকম সাজ পোষাক করতে শিখলে কিভাবে কে জানে। একদম একটা
চেড়ির মত দেখাছ্ছে। যাও হাত মুখ ধুয়ে এখানে এসে বসো। একটা মজার গল্প শোনো…’
‘Baba will not
say a thing. He is not like you. You can be really horrible, Ma.’
বিষদৃষ্টিতে আমাকে প্রায় ভস্ম করে দিয়ে মেয়ে বেরিয়ে গেল ঝড়ের মত। দড়াম করে তার
ঘরের দরজা বন্ধ হল। দরজার কাছে গিয়ে শুনি মেয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সাহস পেলাম
না বিরক্ত করার।
মনটা খারাপ হয়ে গেল। মেয়ে কাঁদলে কোন মা’রই বা ভাল লাগে ? কিন্তু এখন নরম হলে চলবে না। তিতির বিদেশে জন্মেছে,
বড় হয়েছে – সবই ঠিক। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করেছি যাতে আমার ছেলে মেয়ে
নিজেদের শিকড় ভুলে না যায়। ওরা যতদিন ছোট ছিল ততদিন সব কিছু ঠিকঠাক ছিল। তিতির
বাংলা গল্প শুনতে ভালবাসত। টুনটুনির বই আর আবলতাবল মুখস্থ ছিল ওর। বাঙলা গান গাইত
নিজের মনে। ওকে বাঙলা পড়তে আর লিখতেও শিখিয়েছিলাম। আমার ছেলে কাটুমকেও। সব ভুলে
গেছে দুজনেই। এখন তাদের বাঙলা বলতেও কষ্ট হয়।
জানালার বাইরে রাত গভীর হছ্ছে। রাস্তায় গাড়ির আওয়াজ কমে আসছে। আমাদের ছোট্ট
বাড়িতে প্রায় কোন শব্দ নেই। প্রাণেশ কখন ফিরবে কে জানে। আজকাল প্রায়ই ফিরতে দেরী
হয় তার – অফিসে নাকি অনেক কাজ। আজ বলেছিলাম ফারুকের দোকানে যেতে –
অনেকদিন পাঁঠার মাংস আসেনা বাড়িতে। যাবে কিনা কে জানে?
সোমাদের নেমন্তন্ন করেছি শনিবার। মেয়েটা পাঁঠার মাংস বড়
ভালবাসে….
অন্যমনস্ক ভাবে CD playerটা চালিয়ে দিই। রাজেশ্বরী দত্তর গলায় বেজে ওঠে ‘
এ পরবাসে রবে কে’। মনে
পড়ে গেল গতকাল এই গানটা শুনছিলাম মন দিয়ে। অম্লান বার বার করে অনুরোধ করেছে ওদের
নাটকের জন্য গান বেছে দিতে। বলেছিল স্ক্রিপ্টটাও একটু দেখে দিতে। ওর নাকি এখন
বাঙলা লিখতে একটু অসুবিধা হয়। বানান ঠিক থাকে না,
সাধারণ ইংরিজি কথাগুলোর বাঙলা অনুবাদ মনে পড়ে না চট করে।
‘নাটকের সংলাপ তো আর বেনারসির মত ভারি হলে চলবে না?
ফুরফুরে জামদানী চাই। তুমি একটু দেখে দাও।‘
‘তা কেন অম্লান? এই তো বেশ ঝরঝরে বাঙলা বলছ। জামদানী আর বেনারসি?
এ তো অমিত রায়ের মত কথা!’
লজ্জিত হেসে বলেছিল ‘মনে তো সবই আছে দিদি। এখনো সময় পেলেই রবীন্দ্র রচনাবলি খুলে
বসি। কিন্তু বেচাকেনা করতে করতেই দিন কেটে যায়। বাকি সময় নাটক নিয়ে পড়ে থাকি।
ভাগ্যিস কিছু লোক এখনও আছে আমার সাথে!’
ওদের গতবছরের নাটকের কথা মনে পড়ে যায়। শীর্ষেন্দুর একটা গল্পভিত্তিক নাটক।
অম্লান আর ওর বৌ মিতা লিখেছিল তার স্ক্রিপ্ট। অভিনয়ও বেশ ভাল হয়েছিল। বিজয়া দশমীর
পর নাটক। আসেপাশে, এমনকি অনেক দূর থেকেও বাঙালিরা এসেছিল। বেশ একটা মেলার মত ব্যাপার। নাটকের
শেষে বাইরে এসেছি চা খাব বলে। পাশে বেশ একটা বড় দল আড্ডা মারছে। বয়স কম এদের –
সবই প্রায় অচেনা মুখ। টুকরো টুকরো আলোচনা কানে ভেসে আসে
‘কেমন লাগল নাটক তোমাদের?
বেশ ভাল হয়েছে, তাই না?’
‘হ্যাঁ, মন্দ না। তবে কি জানেন,
আমার কিন্তু হালকা নাটক বেশী ভাল লাগে। এই সব একাকিত্ব,
টানাপোড়েন, existentialism – বড় বেশী গম্ভীর।
‘ঠিক বলেছ মৌ। বেশ জমজমাট একটা নাটক,
বেশ ধুমধাড়াক্কা, নাচ গান থাকবে, আমরা প্রাণ ভরে হাসব –
আরে এখানে তো আমরা মজা করতে এসেছি –
তাই না?’
‘যাই বল, আমার কিন্তু ভাল লেগেছে’
‘আরে ভাই, তুই কলেজস্ট্রিটির আঁতেল। তোর তো ভাল লাগবেই। আমরা অত
বুঝিনা’
‘গত বছরের নাটকটা বরং এর থেকে অনেক ভাল ছিল। আমার ছেলেমেয়ে
তো বাঙলা বোঝেই না। কিন্তু ওরাও খুব এনযয় করেছিল।‘
‘গত বছর তো শুভ্ররা নাটক নামিয়েছিল। কই ওদের তো দেখলাম না আজ?’
‘আমি তো শুনলাম ওরা আলাদা একটা দল করেছে। নাটক করবে না আর।
ওরা নাকি এখন থেকে শুধু নাচ গানের প্রোগ্রাম করবে।
‘ও মা, তাই নাকি? ওরা তো সব গলায় গলায় বন্ধু। এখন বুঝি মুখ দেখাদেখি বন্ধ?’
‘অতো জানি না তবে হতেই পারে। বাঙালিদের তো এই স্বভাব। সবার
এতো ইগো…’
‘আরে আমি তো তাই বলি – খানাপিনা মস্তি করো। এইসব গঠনমূলক কাজ করতে গেলেই যত
ঝামেলা।। চাঁদা দেব, পূজোতে যাব, ফাংসন দেখব – এই হোলো আমার attitude। ফেল
কড়ি মাখো তেল…’
আমি সন্তর্পণে চায়ের কাপ নিয়ে ওখান থেকে সরে গিয়েছিলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে মনে
পড়ে গিয়েছিল কাকামণির হেরে যাওয়া মুখ। আমাদের পাড়ার বনেদি পূজোটা যেদিন দুভাগ হয়ে
গেল। আর তারপর ভাঙতে ভাঙতে শেষ হয়ে গেল একদিন।
দরজায় চাবির শব্দে তাড়াতাড়ি উঠে বসলাম। প্রাণেশ দুহাতে দুটো বিরাট ব্যাগ নিয়ে
ঢুকে।
‘কিগো, অন্ধকারে ভূতের মত বসে আছ কেন?
ও, গান শুনছো? তা আলোগুলো জ্বালিয়ে নিলেই পারো?
আমি তো ভাবলাম বাড়িতে কেউ নেই’
আমি ওর হাত থেকে ব্যাগদুটো নিই।
‘কি এনেছ এতো? আমি তো ভাবছি তোমার এত দেরী হছ্ছে কেন।‘
‘আরে সুমি, আজ দারুণ বাজার করেছি,
বুঝলে! ফারুকের দোকনে তো গেলাম আগে। সে জানালো রাজুর দোকানে
আজ টাটকা চালান এসেছে। মাছ আর তরিতরকারি। চলে গেলাম সেখানে। দেখ কত কিছু এনেছি।
বেশ জমিয়ে রান্না কর কদিন। এক বোতল সর্ষের তেলও এনেছি। কি জানি তোমার ভাণ্ডারে আছে
কি না?’
আমি ব্যাগ খালি করতে তাড়াতাড়ি যাই রান্নাঘরে। প্রাণেশ একটা বিয়ার নিয়ে জমিয়ে
বসে সোফাতে। টিভিটা চালিয়ে দিয়ে বলে ‘স্যামি কই? দেখছি না তো? বেরিয়েছে নাকি?’
‘ওর নাম সম্পূর্ণা। তুমিও কি ভুলে গেলে?
কত শখ করে তোমার বাবা ওর নাম দিয়েছিলেন মনে পড়ে?
নয়তো তিতির বল। স্যামি আবার কি নাম?’
‘উঃ আবার শুরু করলে তো! সব কথায় এত খুঁত ধরো কেন?
ওকে তো সবাই স্যামি বলে ডাকে। নীলও ডাকে তো!’
‘নীলান্জন নীল হয়েছে এখানে। মন্দের ভাল। তাই বলে স্যামি?
‘আছ্ছা ঠিক আছে। মানলাম। কিন্তু সে কোথায়?’
‘নিজের ঘরে শুয়ে আছে। বেরোতে বারণ করেছি তাই।‘
‘তুমি বড় uncompromising, সুমি। আমরা কি এখন দেশে আছি নাকি?
কেন বোঝো না আমাদের ছেলেমেয়েরা এখানে জন্মেছে,
এখানে বড় হয়েছে। আমাদের মত দম বন্ধ করা শাসনের অচলায়তনে বড়
হয়নি তো? এই সেদিন Roxanne-র ছবি নিয়ে কি অশান্তিই না করলে….’
‘ওর নাম রূকসানা’ দাঁতে দাঁত চেপে বলি। ‘আমিনা আমাকে ফোন করে কত কাঁদল সেদিন। জানো,
ওদের সমাজে মেয়েটাকে নিয়ে ঢি ঢি পড়ে গেছে?’
‘ওদের সমাজ ঐ রকমই, সুমি। মধ্যযুগ থেকে এখনো বেরোতে পারলো না। তা বলে তুমিও তাই
করবে নাকি? আর কবে বদলাবে সুমি? পঁচিশ বছর তো হয়ে গেল। এখনও ঐ ফালতু বাঙালিয়ানা ছাড়তে পারলে
না? এখনও
স্বপ্ন দেখ তোমার বাঙালি বৌ আর জামাই হবে। কি তোমার এত টান?
থাকতে পারবে কলকাতায় এখন?
পারবে না। ছেলেটা তো কবে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। মেয়েটাকেও
তাড়াতে চাও? কেমন মা তুমি সুমি? দাঁড়াও আমি গিয়ে দেখি মেয়েটা কি করছে।‘
কান্না চেপে ব্যাগ নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকি। প্রাণেশ আজ সত্যি অনেক বাজার রেছে। কাঁচকলা,
মোচা, পালং শাক, ঢ্যাড়স, ঝিঙে, কাঁচা লঙ্কা আর নারকোল একটা ব্যাগে। অন্য ব্যাগটাতে রুই,
ভেটকি আর ইলিশ মাছ, পাঁঠার মাংস, শর্ষের তেল, পোস্ত, চানাচুর, ফুচকার খোল – আরো কত কি। দুদিনের পর তিনদিন বাঙালি রান্না না হলে
প্রাণেশের মেজাজ সপ্তমে। প্রায় প্রতি রবিবার ফরমাস হয় ফুলকো লুচি আর সাদা আলুর
তরকারির। এখানে পূজোর সময় ও ছুটি নেবেই। আমাকেও ছুটি নিতে হয়। গাড়ি নিয়ে আমরা এক
মণ্ডপ থেকে আর এক মণ্ডপে ঘুরে বেড়াই। খিচুড়ি,
লাবড়া, বেগুন ভাজা আর পায়েস খাই কব্জি ডুবিয়ে। বিজয়া দশমীর দিন ও
আমাকে ঠেলে পাঠায়। এখানকার পূজো আমার ভাল লাগে না। ভাল লাগে না মহিলাদের শাড়ি গয়নার
চাপা প্রতিযোগিতা। ভাল লাগে না কৃত্রিম ধুনুচী নাচ আর কলকাতা থেকে ভাড়া করে আনা
পুরুতের সংক্ষিপ্ত পূজো। তবুও প্রতিবছর যাই। কেন কে জানে।
প্রাণেশ উত্তর কলকাতার ছেলে।হুল্লোড়ে, প্রাণবন্ত। যে কোনো পূজোতে গিয়ে ঢাক বাজাতে বসে যায়। উদ্দাম
ধুনুচী নাচ নাচে। দরকার হলে ধুতি পান্জাবির ওপর বিশাল এপ্রন পরে পরিবেশন করতে লেগে
যায়। আমি পারি না। ওর আঙুলের পলা গোমেদ দেখে কেউ কোন প্রশ্ন করলে তাকে গ্রহ
নক্ষত্র পাথর ইত্যাদি নিয়ে লম্বা লেকচার দেয়। প্রাণেশ খুব জনপ্রিয় এখানে। আমার
মেয়ে নিজে থেকে ঘাঘরা, লহেঙ্গা এমণ কি শাড়িও পরে নেয় নিজে থেকে। পূজোমণ্ডপে
মহিলাদের সাথে বাঙলা বলে। নীলান্জন ওরফে কাটুম আর যায় না আমাদের সাথে। বলে ‘I
can’t relate.’
আর আমি? আমি এইসব ক্লাবঘরে বসে মনে করি আমার ছোটবেলার পূজোর কথা। চার দিনের সেই টানটান
উত্তেজনা। মা কাকিমা ঠাকুমার সাথে মণ্ডপে বসে মালা গাঁথা,
চন্দন বাটা, নৈবিদ্য সাজানো। পূজোর চারদিন পাড়ায় কোনো বাড়িতে রান্না হত
না। পাড়ার সবাই এক সঙ্গে খেত লম্বা টেবিলে বসে। আমা নুন লেবু জল দিতাম। পরিবেশন করা
ছিল বাবা কাকাদের দায়িত্ব। তাঁরা বড় বড় বালতি নিয়ে কোমরে গামছা বেঁধে মহানন্দে ঐ
অত লোক খাওয়াতেন।
বিজয়া দশমীর দিন বাড়ির সব মেয়ে বৌরা যেতেন মা দূর্গাকে বরণ করতে। ছোটো কাঁসার
রেকাবিতে পান, সিঁদুর, বাড়িতে বানানো নারকোল নাড়ু, সন্দেশ, ধান দূর্বা। সধবারা বরণ শেষ হলে একে অন্যের কপালে সিঁদুর
ছোয়াতেন। আধুনিক উদ্দাম ‘সিঁদুর খেলা’ দেখিনি কখনো। ঠাকুমা প্রতিমার সামনে দাঁড়িয়ে বলতেন ‘সবাইকে ভাল রেখো মা। আগামী বছর তোমায় যেন আবার দেখে পাই।
শক্তি দাও। শুভ হোক সবার।‘
এই কি শিকড়ের টান? এই অযৌক্তিক মোহ আর ভালবাসা?
মন খারাপ হলেই রবীন্দ্রনাথ,
জীবনানন্দ, শক্তি, সুনীল, শঙ্খ ঘোষ? প্রতি বছর অসীম আগ্রহে পূজাবার্ষিকি সংগ্রহ করা –
লেখাপত্র যেমনই হোক? দূর বিদেশে আপ্রাণ চেষ্টা নিজের ভাষা,
নিজের সংস্কৃতির কিছুটা পরবর্তি প্রজন্মকে দিয়ে যাওয়ার? যে শিকড় উপড়েছি স্বেছ্ছায় বা নিছক প্র্রয়োজনে তাকে যেন তেন প্রকারেণ বাঁচিয়ে
রাখা? প্রতি
বছর কলকাতা ফিরে সেই শিকড়ের সন্ধান – রাস্তায় ফুচকা ঝালমুড়ি তেলেভাজা রোল;
পার্ক স্ট্রিট, গড়িয়াহাট, একাডেমি, নন্দন, কলেজ স্ট্রিট, কফি হাউস; আমার জীর্ণ পুরোনো পাড়া,
ঝাঁ চকচকে বহুতল অট্টালিকার দাপটে মুমূর্ষ। ব্যাঙের ছাতার
মত গজিয়ে ওঠা ঠাণ্ডা নিঃশব্দ বহুতল মল আর আকাশপুলের ছায়ায় গুটিয়ে যাওয়া পুরোনো
রাস্তাগুলো টের পাইয়ে দেয় আমার শহরের পরিবর্তন। শিকড় নেই আর। দ্রুত বদলে গেছে আমার শহর। তার অন্য রূপ এখন,
অন্য ভাষা, অন্য সংস্কৃতি। বিশ্বায়ন সম্পূর্ণ এখানে,
পদে পদে টের পাই ফিরে আসি যথন। বারবার,
প্রতিবার। আমার শহর এক অচেনা জগৎ আজ। তবু কেন এত টান কে
জানে!
No comments:
Post a Comment